সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান বলতে কী বুঝ? সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা
ভূমিকা: সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো সংখ্যালঘুদের সমাজবিজ্ঞান। এ বিজ্ঞান সংখ্যালঘুদের অবস্থা সংখ্যালয় ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্পর্ক, সংখ্যালঘু গতিশীলতা, ধর্মীয় সংখ্যালযুত্ব, সংখ্যালপুর উন্নয়ন, সংখ্যালঘু জীবনযাপন ও সংখ্যালঘু আইনসহ সার্বিক পরিস্থিতি জানতে সহায়তা করে থাকে।
Minority শব্দটি ১৫ শতকে প্রথম ব্যবহার করা হয়। একটি বৃহত্তর সমাজে যখন কোনো অন্য বৈশিষ্ট্যের বা অন্য সংস্কৃতিমনা লোকেরা বসবাস শুরু করে তখন তাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলা হয়ে থাকে। এ সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা কম থাকে আবার কোনো সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা তুলনামূলক বেশি থাকে। একটি দেশের অভ্যন্তরে তুলনামূলক কম লোকসংখ্যা সম্প্রদায়কে Minorky বা সংখ্যালঘু হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান: সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান শব্দটি দুটি প্রত্যয়ের সমাহারে গঠিত। একটি হলো সংখ্যালঘু, অপরটি হলো সমাজবিজ্ঞান। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
সংখ্যালঘু: আধুনিক বিশ্বে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী প্রায় সব বৃহৎ রাষ্ট্রেই রয়েছে। সংখ্যালঘু অর্থ সংখ্যায় ছোট বা অল্প। বড় পরিমাণেও চেয়ে তুলনামূলক পরিমাণে ছোট বা কমকে সংখ্যালঘু বলে।
Phillip Kottak তাঁর 'Antropology' গ্রন্থে সংখ্যালমুর সংজ্ঞা সম্পর্কে বলেছেন, 'সংখ্যালঘু হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্রমমানের একটি অধীনস্থ গোষ্ঠী, যাদের ক্ষমতা এবং সম্পদের অধিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর চেয়ে কম থাকে।
'Oxford Dictionary'-তে Minorit শব্দের অর্থে বলা হয়েছে যে, মানুষের একটি ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী যারা জাতি, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদির দিক দিয়ে অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা।
Webster's Seventh New Callegiate Dictionary'-তে Minority-এর সংজ্ঞা, দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি অংশ যার। প্রায়শ ভিন্ন আচরণ করে থাকে।
F. J. Brown সংখ্যালঘু সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, "সংখ্যালঘু হচ্ছে কোনো বৃহৎ সমাজ বা দেশে বসবাসরত এমন এক জনগোষ্ঠী, যারা সে দেশের আর্থসামাজিক দিক থেকে প্রভাবশালী বৃহৎ জনগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও শাসিত।"
Neli J. Smeber সংখ্যালঘু সম্পর্কে উল্লেখ করেন, "সংখ্যালঘু বলতে এমন একটি মানবগোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা শারীরিক অথবা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সমাজ থেকে অসম আচরণ পেয়ে থাকে।" সমাজবিজ্ঞান: যে শাস্ত্র সমাজের মানুষের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, আচার আচরণ, রীতিনীতি, ধ্যানধারণা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে তাকে সমাজবিজ্ঞান বলে।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইয়ার তাঁর 'Society' গ্রন্থে বলেছেন, "সমাজবিজ্ঞানই একমাত্র বিজ্ঞান, যা সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে পাঠ করে।"
ডুর্খেইম-এর মতে, "সুম্রাজবিজ্ঞান হলো অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান।" ডেভিড ড্রেসলার তাঁর Sociology গ্রন্থে বলেছেন, "সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়ার বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন।
সুতরাং, সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান বলতে সমাজের সে সফল ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে বোঝায় যারা জাতি, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদির দিক দিয়ে অনাদের চেয়ে আলাদা।
সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
১৮৩৯ সালে অগাস্ট কোঁতের হাত ধরে সমাজবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হলেও সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক বিকাশ ঘটে পরবর্তীকালে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে। ১৯৩৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘু অধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নগুলো নতুন গুরুত্ব পায়।
সমাজবিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে, একটি বৃহৎ সমাজে ধর্ম, ভাষা, জাতি বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে আলাদা জনগোষ্ঠী বসবাস করে, যারা নানা বৈষম্যের শিকার। এই উপলব্ধি থেকেই সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞানের সূচনা ঘটে।
সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। ৮০-এর দশকের পর থেকে এর কার্যক্রম ও মাত্রা অতিদ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের শরণার্থী সমস্যা এ বিজ্ঞানই তুলে ধরছে। সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠদের পার্থক্য নির্ণয় করে দিচ্ছে। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের গবেষণার আওতায় এনে সমাধানের চেষ্টা করছে। অতি অল্প সময়েই সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নৃগোষ্ঠী, উপজাতি, এখনিক গ্রুপ, বর্ণগোষ্ঠীসহ সকলকেই এ বিজ্ঞান একটি সামাজিক কাঠামোতে নিয়ে এসেছে। সমাজকাঠায্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এসেরকে এখন গুরুত্ব দেওয়া দেওয়া হচ্ছে। সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান এক্ষেত্রে সফলতার সাথে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে আধুনিকতার কল্যাণে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তথ্য নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এতে সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান সমৃদ্ধি লাভ করেছে।
সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক কাঠামোগত প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এ সমাজবিজ্ঞান উপজাতি, গোত্র, জাতি, আতীয়তা, এখনিক, আদিবাসী, নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্ব, ভূমি বিচ্ছিন্নকরণ, জঙ্গলের অধিকার ও নারী সংখ্যালঘু প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে থাকে। ক্রমান্বয়ে সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান উৎকর্ষতা লাভ করেছে। বাংলাদেশেও এর ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। বর্তমানে প্রায় সব মহলেই সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। প্রতিনিয়তই গবেষণার ফলে এর সম্প্রসারণ ঘটছে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, প্রায়োগিক সামাজিক গবেষণার ফলে সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞান অনেক বেশি উন্নতি লাভকরেছে। এ শাস্ত্র সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের তুলে ধরছে এবং সেই সাথে সমাধানেরও চেষ্টা করছে। তাই একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে সংখ্যালঘু সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ নিঃসন্দেহে অধিক গুরুত্ব বহন করে থাকে।

No comments:
Post a Comment